ঐতিহ্যবাহী মিয়ারহাট বাজারের শতবর্ষের অধিক সময়ের একটি ঐতিহ্য হলো এই হোগলা পাতা থেকে শুরু করে এর তৈরী বিভিন্ন জিনিসপত্র বেচাকেনা। হোগলা উপকূলীয় অঞ্চলের খুবই পরিচিত একটি জলজ তৃণ উদ্ভিদ। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা বা কাদামাটি যেখানে বর্ষায় বা দীর্ঘ সময় জলমগ্ন থাকে এ রকম জমিতে হোগলা পাতা জন্মে। পলিমাটি সমৃদ্ধ মাটিতে প্রাকৃতিক ভাবেই বংশ বিস্তার করে থাকে হোগলা গাছ।
যেহেতু এটি উপকূলীয় অঞ্চলেই বেশি জন্মে তাই মিয়ারহাটে সাধারণত হোগলা পাতা আমদানী করা হতো বিভিন্ন ধরনের নৌকা যোগে। একসময়ে মিয়ারহাট বাজারের পাশের খালটিতে দেখা যেতো হোগলা পাতা বোঝাই করা নৌকার পাল। কিন্তু সেই নৌকার পাল আর দেখা যায় না, দেখা গেলেও একটা কি সর্বোচ্চ দুটো।
একসময়ে মিয়ারহাট অঞ্চলে যারা সবচেয়ে বেশি হোগলা পাতা আমদানী করতেন তাদের একজন ছিলে ভূবন ভক্ত। সমসাময়ীক আমদানী করা ব্যক্তিগণ পরলোক গমণের পর থেকেই এ অঞ্চলের হোগলা শিল্পের জৌলুস হারাতে শুরু করেছে। একসময়ে হোগলা পাতা দিয়ে মিয়ারহাট অঞ্চলের অনেক মানুষ তৈরী করতেন বাহারি ডিজাইনের শীতল পাটি যা হোগলা চাটাই নামে পরিচিত ছিলো; ব্যবহার হতো মক্তব, মসজিদ, মাদ্রাসা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ঘুমানোর জন্য ওই পণ্যটি ছিল অন্যতম মাধ্যম। এছাড়া তৈরী করতেন হাতপাখা; যার ঠান্ডা বাতাসে মন-প্রাণ শীতল হয়ে যেতো। পূজা-অর্চনা, ঘরের ছাউনী, বেড়া ফসল রাখার টুকরী, ক্ষেতের বেড়াসহ নানাহ সাংসারিক কাজে ওইপণ্য ব্যবহার হতো।
দারিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের কাছে শীতল পাটি হিসেবে হোগলা চাটাই ছিলো বহুল পরিচিত নাম। মিয়ারহাট বাজারে হাট বসে সপ্তাহে দু’দিন শুক্রবার ও সোমবার। আর এ দু’দিনে হাটে বিক্রি হতো হাজার হাজার হোগলার চাটাই। হাটের সময় শেষ হলে দেখা যেতো ট্রাইভর্তি চাটাই চলে যাচ্ছে অন্য অঞ্চলে। কিন্তু আজ এসব তেমন একটা দেখা যায় না।
একসময়ে অত্র এলাকার হিন্দু-মুসলিম সকলেই নিয়মিত হোগলার চাটাই বুনে অনেক অর্থ উপার্জন করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে মুসলিম কাউকে তো হোগলার চাটাই বুনতে দেখাই যায় না, টুকটাক যা লক্ষণীয় তা হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু কিছু বাড়িতে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হোগলার তৈরী এসব পণ্যের বিকল্প চলে আসায় আগের মতো চাষাবাদ হচ্ছে না হোগলা গাছের। তাই দিনে দিনে বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে হোগলা শিল্প।
এই ঐতিহ্য, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি মিয়ারহাট অঞ্চলের অনেকেই চাইলে এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে শুরু করতে পারেন হোগলা চাষের। কেননা পলিমাটি সমৃদ্ধ বা জলাশয়ে এগুলো খুব সহজেই চাষাবাদ করা যায় নেই বাড়তি খরচ কিংবা পরিচর্যার ঝামেলা। তবুও বেঁচে থাকুক ঐতিহ্যবাহী হোগলা শিল্প।
মোঃ টিপু সুলতান, মিয়ারহাট, কালকিনি, মাদারীপুর